কবি পরিচিতি :


রবীন্দ্র উত্তর তথা রবীন্দ্র আলোকবৃত্তের কবিদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি অজিত দত্ত । তিনি প্রচলিত কবিতার নিয়মের গণ্ডি ভেঙে প্রথম সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । বাংলাদেশের এক শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসেন কবি অজিত দত্ত ।  তাঁর শৈশব বাংলাদেশে , তারপর শিক্ষা কলকাতার নামী কলেজে । ইংরেজিতে স্নাতক হন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে অধ্যাপনা করেন নানান উল্লেখযোগ্য শিক্ষায়তনে । ইংরেজিতে স্নাতক হওয়ার সুবাধে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যদেশীয় কাব্য পাঠের সুযোগ লাভ করেন।   কর্ম জীবনের সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই কল্লোল পত্রিকার কুলবর্ধন কবি বুদ্ধদেব বসুর সখ্যতা ও সাহচর্য বাংলা কাব্য কবিতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। 

নোঙর কবিতা

আলোচ্য নোঙর কবিতাটি একটি রূপক আশ্রিত কবিতা ইংরেজিতে যাকে বলে allegorical poem । এবং ভাবনায় ও বিষয় আঙ্গিকে প্রকৃত ভাববাদী রূপক আশ্রিত কবিতা । "শাদা মেঘ কালো পাহাড়"(১৯৭০) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

আলোচ্য কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ সাংকেতিক ভাষায় কবিপুরুষ অজিত দত্ত ব্যক্তিজীবনের গভীর দিকটি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন । তাই তিনি উপস্থাপন করেছেন একাধিক রূপক আশ্রিত শব্দবন্ধের।  আমরা কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে সেটি অনুধাবন করার চেষ্টা করবো —


•• বিষয়বস্তুর রূপরেখা ••


কবিতার প্রথম কবিতার প্রথম ছত্রে দূর সিন্ধুপারে সাংসারিক জীবনের জটিলতা থেকে বন্ধন থেকে অনির্দিষ্ট লক্ষপথে বেরিয়ে পড়ার একটি ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু

 “নোঙর গিয়েছে পড়ে তটের কিনারে।…

আসলে বেরিয়ে পড়তে গেলে যে প্রাণশক্তি ও মনোবল প্রয়োজন কবির আর তা নেই ! সময় অনেকটা অতিক্রান্ত । অর্থাৎ কবিতা রূপকের আধারে সাংসারিক দায়বদ্ধতায় কঠিন আটকে পড়ে আছেন নাহলে কবিসত্তা অনির্দিষ্টের দিকেই যেতে চান। একটি সময়ের পর অনুভবি কবির মনে হয়েছে এতদিন ধরে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তিনি মিছে দাঁড় টেনেছেন।  সাংসারিক জীবনের বন্ধন থেকে মানস মুক্তি কবি প্রত্যাশা করেছেন।  “আমি  চঞ্চল হে― / সুদূরের পিয়াসী… রবি  ঠাকুরের এই গানের সাথে আলোচ্য কবিতার ভাবনা কিছুটা হলেও যেন মিলে যায় । এখানেও কবি সুদূরের অভিমুখে মুক্ত বিহঙ্গের মতো বেরিয়ে পড়তে চান। কিন্তু কবি তা করতে পারেন না । জোয়ারের উত্থান  ও ভাটার শোষণের মতই তুলনা টেনে বাস্তবের অভিঘাত সমস্যাভরা মানবজীবনের দিকটি কবি দেখিয়ে দিয়েছেন কবিতার রূপক আশ্রিত শব্দবন্ধে। 


জীবনরূপ তরীতে চেপে গতিশীলতার সাথেই জীবন এগিয়ে চলেছে। সেখানে কোনো কূল খুঁজে পাওয়াই দায় হয়েছে। কবি বলেছেন “আমার বানিজ্য-তরী বাঁধা পড়ে আছে।” অৰ্থাৎ কবিতার জীবনে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি খুঁজে পাননি ।তিনি হয়তো আরো সৃষ্টি কর্মে নিযুক্ত হতে পারতেন , তুচ্ছ সাংসারিক দায়িত্বের কারণে তা হয়তো সম্ভবপর হলো না। এখানে কবিসত্তার গভীরে এক জীবনে অপরিপূর্ণতার পরিতৃপ্তিহীন অনুভূতি প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কবির তবু জীবনের দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে  নিরন্তর চেষ্টা করে চলেন কিন্তু জীবনযাপন যখন পার্থিব টান সন্তান পরিবার পরিজনদের ছেড়ে যেতে পারেন না। জীবন স্রোত যেনো জীবনের বিবেকবোধ থেকেই  কবিকে বিদ্রুপ করে । তখন “নিস্তব্ধ মুহূর্তগুলি ”তে কবি চেতনাকে নাড়া দেয়। কবি ‛বিরামহীন দাঁড়’ টেনেও জীবনের লক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছেন  “ ...যতই তারার দিকে চেয়ে”  সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চান কিন্তু পারেন না। ঠিক ভুলের হিসাব খুঁজে উঠতে পারেন না।


সংসার যাপনে কর্তব্য বোধ থেকে মোহ থেকে কবির আর মানস মুক্তি , প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সঠিক ঠিকানা খোঁজা হলো না। 

                  "ওগো সুদূর বিপুল সুদূর

তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী..."

কবি ভারাক্রান্ত । জীবনের অনেকটা পথ আজ পিছনে ফেলে এসেছেন 

"... মোর ডানা নাই,আছি এক ঠাঁই

সে কথা যে যাই পাশরি…”

জীবনের গন্ডিবদ্ধ একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তির সন্ধান ও নিরন্তর চেষ্টা চলতেই থাকে। কিন্তু  বৃথা চেষ্টা , আমরা শত ইচ্ছাতেও পারেন না । এখানে কবিতায় কবিসত্তার গভীরে এক বিষণ্নতা , হতাশার কথাগুলি কবিতা রূপকের আধারে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ।এই বোধ ও ভাবনা তাই সমগ্র অনুভূতিপ্রবন মানব জীবনের সাথে মিলে যায়।


নোঙর