মনের টানে  ফেলে আসা সময়ের অমলিন ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত

― আলোচনায় হিরন্ময় মুখার্জী ।


অসুখী একজন কবিতায় বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের দিক থেকে একটি অতীত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা কি রকম ছিল সেটা যদি জেনে নিতে পারি তাহলে কবিতাটি বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে । তাই অতি সংক্ষেপে জেনে নিতে পারি কি ছিল সেই অতীত ইতিহাসের সঙ্গে কবিতার মেলবন্ধন ঘটেছে । স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা তোমরা সকলেই ইতিহাসে পড়েছ । ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ও শাসনতন্ত্রের প্রেক্ষাপট তৎকালীন স্থানীয় যুবকদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো হয় এবং নানারকম প্ররোচনা দেওয়া হতো  পরিবার ত্যাগ করার জন্য।  আর যুদ্ধে লিপ্ত করা দু'ভাবে হতে পারে এক, দেশমাতৃকার জন্য দেশমাতৃকার জন্য (দুই)জোরকরে। সেই স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের সময় কবি  ফ্যাসিবাদবিরোধী কমিউনিজমের পক্ষে গণঅভ্যুত্থানে তাঁর সৃজনশীল লেখনি ধারণ করেছিলেন এবং যোগদান করেছিলেন। বহু পরিবারের চোখের জল প্রত্যক্ষ করেন। সেকারণেই তিনি একাধারে ছিলেন বিপ্লবী এবং অন্যদিকে বিখ্যাত চিলিয়ান একজন কবি। এই দুইয়ের মেলবন্ধন তার সত্তার গভীরে লুকিয়ে আছে। এ নিয়ে তার কোনো সমস্যা হয়নি। কবি পাবলো নেরুদা জন্মের পর তার নিজের মাকে হারিয়ে ভালবাসার কাঙ্গাল হয়ে পড়েছিলেন। স্নেহ বাৎসল্যের অভাব থেকেই পরবর্তী জীবনে ভালবাসার কাঙ্গাল হয়েছিলেন এবং সফল প্রেমিক সত্তার জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠেন । তাঁর চারিত্রিক নানা বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তবুও তাকে আমরা বিপ্লবী ও প্রেমিক কবি হিসেবেই ধরে নেব ।এককথায় তার কবিতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিপ্লবী সততা এবং কবিসত্তা। আলোচ্য অসুখী একজন কবিতায় কবি জীবনের প্রতিচ্ছবি কিছুটা হলেও আমরা খুঁজে পেতে পারি। কিভাবে সেটা  আমরা কবিতা পাঠে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আমরা দেখে নেবো কবিতায় কে কারা কিভাবে অসুখী কেনইবা অসুখী । তোমরা সবাই জানো সুখের বিপরীত অবস্থা অসুখী। কোন  অবস্থার ফেরে কারা এই কবিতায় এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায় তা আমরা দেখে নেবো। এই প্রশ্নটি সমগ্র কবিতার মূল অনুসন্ধানের শব্দ ।


কবিতার দুটি সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে একটি যুদ্ধের নৃশংসতার রূপ আর অপরটি একটি সুস্থ জনপদের মধ্যে সভ্যতার কলঙ্ক যুদ্ধের রূপ। যেখানে আশা-প্রত্যাশা মত ছবি আমরা দেখতে পাই । মানবিক আবেগের ছবিও দেখতে পাই। এবার আমরা কবিতাপাঠে বিষয়টি বিস্তারিত বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব:


কবিতার প্রথম ছত্রে কথক কোথায় যেন  চলে যাবার কথা বলছে বলেছে । একটি আবেগ দীপ্ত কণ্ঠস্বরে কোন একজনকে প্রতীক্ষার দ্বিপ্রহরে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গিয়েছেন বহুদূরে । সেই মানুষটি প্রতীক্ষারত । সেই মানুষটি জানতো না যে কথক ফিরে আসবে না বলে । কবি কোন এক ব্যক্তির জবানবন্দি নিজের মতো করে কবিতার মধ্যে বর্ণনা দিয়েছেন । আসলে কবি কিন্তু সেই ব্যক্তি বাস্তবে নয় । অন্য ব্যক্তির কথাটি তিনি বলেছেন । 


প্রথম পংক্তিতে দেখতে পাওয়া যায় একটি পরিবর্তিত চিত্রপট যেখানে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে । একটি জনপদের বর্ণিত ছবি চোখের সামনে আমরা কল্পনা করে নিতে পারি যেখানে একটি কুকুর চলে যায় আর গির্জার সন্ন্যাসীনি পথ পেরোনোর ছবি । এবং ফ্ল্যাশব্যাকে দেখি গৃহত্যাগী সেই যুবকের বসতি সেই জনপদের বর্তমান ছবি।  তার অনুপস্থিতিতে  তার চরণচিহ্ন মুছে গিয়ে রাস্তায় ঘাস গজিয়ে উঠেছে । আর সেই মানুষটিকে প্রতীক্ষায় রেখে চলে গিয়েছিল সেই নারীটি কথকের অপেক্ষায় পাথর প্রমাণ সময়ের বোঝা মাথায় নিয়ে সময়কে বছরের-পর-বছর দাঁড় করিয়ে রেখেছে।  কোন কঠিন সময়ে বোঝা বহন করা কি সহজ কাজ?  সেই কঠিন সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।  এরপর বাস্তব ঘটনার ছবি দেখতে পাওয়া যায়।  কোন কারনে কে গৃহত্যাগী হয়েছে আর কেনইবা কে অপেক্ষা করছিল সেই বিষয়টি আমরা পরবর্তী অংশে দেখবো-


এবার আসি সেই যুদ্ধের ঘটনা প্রসঙ্গ সেই যুদ্ধের জ্বলন্ত হিংসাত্মক গ্রুপ আমরা দেখতে পাই যোদ্ধা রূপে সেই যুবক গৃহত্যাগী হয়েছিল একথা আমরা বুঝে গেছি যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের নাই প্রবাহিত লাভাস্রোত এই উপমা নিরিখে রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার ঘটনাকে উত্থাপন করা হয়েছে এরকম উপমায় কবি তুলে ধরেছেন শিশুরা খুন হল এই উপমার মধ্যে দিয়ে প্রাণের বিনষ্ট আর সভ্যতার ধ্বংসলীলা কে বোঝানো হয়েছে এতসব ঘটে গেল কিন্তু সেই প্রতীক্ষারত মেয়েটি বেঁচে যায় এ প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করব শেষে তার আগে যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে আরও কিছু কিছু ঘটেছে সেটা দেখে নেব কবিতার ছত্র ছত্র টিতে কবিতাংশটিতে যুদ্ধের অমানবিক ছবি ফুটে উঠেছে। সমস্ত শুভবুদ্ধির অবসান ঘটে বলেইতো যুদ্ধ সংঘটিত হয় । সমতল জনপদে , নগরে লেলিহান অগ্নি শিখা ছড়িয়ে পড়ে । প্রাচীনত্বের  প্রতিমূর্তি এবং আধ্যাত্মিক শক্তির আধার হলুদ দেবতাগণ তাদের সৌম্য স্নিগ্ধ ধ্যান গম্ভীর মুর্তিগুলি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পারে । হাজার হাজার বছর ধরে দেখা সাধনস্বপ্নের ছন্দপতন ঘটে । যুদ্ধ যদি দেবতাদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয় তাহলে  রক্তমাংসের মানুষজন নিহত হবে একথা স্বাভাবিক। এই অংশটিতে দেবতাদের অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন এনেছেন কবি। আর কারণ হয়তো সাম্যবাদী ভাবধারায় সমর্থক ছিলেন বলেই হয়তো।  যায় নিহত যোদ্ধা জীবনের স্বপ্ন ভঙ্গ তো হবেই কল্পনায় প্রত্যক্ষ করেন তার মৃত লোক বাসস্থানের ছবি যেখানে সাজানো বারান্দা সুন্দর বাড়ি ঝুলন্ত বিছানা আরামের সমস্তটা দর্শক সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে ।ধ্বংস হয়েছে প্রাচীন শখের জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্র। ঘর গরম রাখার চিমনি সব জ্বলে গেল গোলাপি গাছের রূপকে ভালোবাসার ছবি ফুটে ওঠে । সেই ফ্যামিলি ট্রি প্রিয় পার্থিব বস্তুগুলি ভেঙে যায়। করতল এর মত পাতা বিদেশে খুব দেখা যায় সেগুলো ছড়িয়ে রয়েছে । এ রকম দৃশ্যপটে একটা একাকীত্ব নিঃসঙ্গতা আর বিষন্নতার ছবি ফুটে উঠেছে।


শেষ পংক্তিতে যুদ্ধ শেষের ফলশ্রুতি স্বরুপ কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে জনপদের মধ্যে সেটি লক্ষ করা যায়। কাঠ কয়লা লোহার টুকরো ইত্যাদি । পাথরের স্মৃতি সৌধের ধ্বংস প্রাপ্ত কিছু মূর্তি ছড়িয়ে থাকে যা খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। তার সঙ্গে রক্তের কালো দাগের কথা কথক বলেছেন। সময়ের প্রবহমানতায় রক্তরাগও কালো হয়েছে। সময় তো আর কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করেনা । বাস্তবের মাটিতে সভ্যতার রথচক্র নিয়ত চলে যায় । কিন্তু কবিতায় মেয়েটি অপেক্ষা করতে থাকে ।


কবিতার ভিডিও আলোচনা দেখে নিতে পারো
কবিতার সম্ভাব্য প্রশ্নগুলি নিম্নে দিলাম এগুলি তোমরা নিজে নিজে তৈরি করে নিজের ভাষায় লেখো ―


১.অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায়… ” কে কাকে অপেক্ষায় দাঁড় করিয়েছে? ১

২.বৃষ্টিতে ধুয়ে দিলো আমার পায়ের দাগ― কার পায়ের দাগ কেনো ধুয়ে যায়? ৩

৩. ঘাস জন্মালো রাস্তায়― আলোচ্য কবিতায় কোন প্রেক্ষাপটে এই কথাটি বলা হয়েছে ? ৫

৪. পর পর পাথরের মতো,  বছরগুলো নেমে এল তার মাথার ওপর ― কার কথা বলা হয়েছে ? বছরগুলো পাথরের মতো কেনো ছিলো ? ১+২=৩

৫. অসুখী একজন কবিতায় শিশু আর বাড়িরা কিভাবে খুন হলো? ৩

৬. শান্ত হলুদ দেবতা বলতে আলোচ্য কবিতায় কি বোঝানো হয়েছে বলে তুমি মনে করো? দেবতাগণ শান্ত কেনো ?

৭.যেখানে আমি ঝুলন্ত বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম―কে ঝুলন্ত বিছানায় ঘুমিয়েছিল?  কথকের এই কথা মনে হবার প্রসঙ্গ তুমি নিজের ভাষায় বলো । ১+৪

৮. গোলাপি গাছ কি? কোন প্রসঙ্গে উঠে এসেছে এই গোলাপি গাছের প্রসঙ্গকথা নিজের ভাষায় লেখো । ১+৪


#প্ৰশ্ন প্রস্তুত করেছে : 

হিরন্ময় মুখার্জী

( বাংলা পড়াশোনা বিষয়ের গাইড  টিউটর)