সমর সেনের মহুয়ার দেশ কবিতাটির সূচনা একটি সুন্দর কবি কল্পনার মধ্য দিয়ে। নাগরিক কবির চোখ ধরা পড়েছে দুটি ভিন্ন প্রকৃতির ছবি। প্রথম স্তবকের সূচনা হয়েছে নাগরিক দৃশ্যমানতায় সূর্যাস্ত হচ্ছে। “গলিত সোনার মতো উজ্বল আলোর স্তম্ভ”। সূর্য দেব ক্রমশ বর্ণহীন হন। জলের উপর পড়ন্ত রৌদ্রের আলো ছায়া গোধূলি বেলাতে ক্রমশ ঢেউয়ের ধূসর ফেনা নৈরাশ্যে পরিণতি পায়। এরপরেই নাগরিক বাসিন্দা কবি সময় সেন ধুলো, ধোয়ার যান্ত্রিক কলকাতা শহরের বিবর্ন রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। সূর্যের লাল আভা কেটে যেতেই সন্ধ্যার নীরব অলসতার দিনাবসানের অলসতায়, ধূম্র পুঞ্জীভূত শহরকে দেখে দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। মনে হয়―
“ ...শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।”
সেই শীতের জরাজীর্ণতা ও রুক্ষতার মতো লাগে শহরটাকে। তাই কবিমন একদন্ড শান্ত নীরবতা খোঁজেন। কবির মানস চোখে ভেসে ওঠে “মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ।” এর কথা। ছায়া ছন্ন পথের মাঝখান দিয়ে শহর থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চান। কবি সপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়েন। সুন্দর প্রকৃতিতে তিনি আবিষ্ট হয়ে পড়েন ক্ষনিকের শান্তির জন্য। দেবদারু বনের দীর্ঘ রহস্য আর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দও তিনি শুনতে পান। কল্পনাতে ক্লান্তি পেতে নিঃসঙ্গতা ও নির্জনতা থেকে মোহময়ী মহুয়া ফুলের মৃদু মাদকতা ভরা সুবাস উপভোগ করতে করতে নাগরিক বদ্ধতা , দুষণ থেকে তাজা শ্বাস নিতে চান। সবুজের মাধুর্য ভরা বনাঞ্চলে সরল মানুষের জীবন থেকেও সাহচর্য খোঁজেন।
কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে কবি কল্পনার আকাশ থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে এলেন। সাঁওতাল পরগনার মহুয়ার দেশে ঘন বনাঞ্চলে রাত্রি জাপনকালে শুনতে পান -
“ ….কয়লার খনির
গভীর , বিশাল শব্দ।”
কবি কিছুটা চমকিত হলেন, কারণ একদন্ড শান্তি ও নির্জনতার জন্যই তো এসেছিলেন মহুয়ার দেশে। এখানেও শান্তি পেলেন না।সুন্দর সবুজ সকালবেলাতেও কবির স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো।যখন দেখেন ধুলোমাখা, কালিমালিপ্ত , ক্লান্ত অবসন্ন মানুষগুলো সাঁওতাল পরগনার সরল মানুষগুলো নিষ্পেষিত। সারারাত ঘুম নিদ্রা ছেড়ে কয়লা খাদানে কাজ করতে হচ্ছে-এ কোন শান্তির দেশ , কোথায় আনন্দ? মানুষগুলি আতঙ্কিত, দুঃস্বপ্নের মতো তাদের জীবন কেন?
যান্ত্রিক শহর থেকে এসে প্রাকৃতিক শান্ত সতেজতা পেতে গিয়ে মহুয়ার দেশেও যান্ত্রিক বেদনাতে কবির মোহ ভঙ্গ হয়ে গেল। কবির ক্লান্তি মোচনের আশা নিরাশাতে পর্যবসিত হয়।
মহুয়ার দেশ
সমর সেন
(১)
মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে
অলস সূর্য দেয় এঁকে
গলিত সােনার মতাে উজ্জ্বল আলাের স্তম্ভ,
আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়।
সেই উজ্জ্বল স্তব্ধতায়।
ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে
শীতের দুঃস্বপ্নের মতাে।
অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,
সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে
দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য,
আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস
রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলােড়িত করে।
আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,
নামুক মহুয়ার গন্ধ।
(২)
এখানে অসহ্য, নিবিড় অন্ধকারে
মাঝে মাঝে শুনি।
মহুয়া বনের ধারে কয়লার খনির
গভীর, বিশাল শব্দ,
আর শিশিরে-ভেজা সবুজ সকালে
অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলাের কলঙ্ক,
ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়।
কীসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।
![]() |
| মহুয়া ফুল@আনপ্ল্যাস |

0 মন্তব্যসমূহ